বইপ্রেমী বাবাকে দেখে ‘বইপাগল’ হয়ে ওঠেন নরসিংদীর মাওলানা ডা. অছিউদ্দীন। গড়ে তোলেন জাগরণী পাঠাগার। এবার ৫৬ বছরে পড়ল পাঠাগারটি। পাঠাগারে বই আছে ২০ হাজার। আছে ৫০ বছরের পত্রিকার কাটিং ও দুর্লভ সংগ্রহ।

টিফিনের টাকায় পাঠাগার
অছিউদ্দীনের বাবা হাজী ইলিয়াস মাস্টার ছিলেন শিক্ষক। অবসর পেলেই বই পড়তেন। ছেলেবেলায় বাবার বই পড়া দেখে বইয়ের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় অছিউদ্দীনের। বই পড়া শুরু করেন। পছন্দের বই জমাতে থাকেন টিনের বাক্সে। টিফিনের এক-দুই পয়সা বাঁচিয়ে কেনেন বই। একদিন সহপাঠীরা বাড়ি এলে উঠোনে মেলে ধরেন সেই বাক্স। বন্ধুরা রীতিমতো অবাক! বন্ধুদের নিয়ে পাঠাগার করলেন। নাম দিলেন ‘কিশোর সমিতি’। এ নামে চার বছর চলে। ১৯৬৮ সালে নাম রাখেন জাগরণী সমিতি। ১৯৭০ সালের ২০ আগস্ট পাঠাগারটি পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সমাজকল্যাণ বিভাগ থেকে রেজিস্ট্রেশন পায়। পরে ২০১১ সালে গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর থেকে নরসিংদী জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগারের মাধ্যমে ‘জাগরণী পাঠাগার’ নামে পরিচিতি ও সনদ লাভ করে। ডা. অছিউদ্দীন বললেন, ‘তখন ১৯৬৮ সাল, আমি পুরান ঢাকায় থাকি। ফুটপাতে দোকানিরা বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসত। হাত খরচের টাকা বাঁচিয়ে ২৫ পয়সা, ৫০ পয়সা কিংবা এক টাকায় বই কিনতাম। বইয়ের পাহাড়ই গড়েছি আমি।’

২০ হাজার বইয়ের ভাণ্ডার
প্রায় ২০ হাজার বই আছে জাগরণী পাঠাগারে। উপন্যাস, গল্প, কবিতা, ইতিহাস, বিজ্ঞান ও ইসলামবিষয়ক নানাধর্মী বই রয়েছে। সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, কায়কোবাদসহ অনেকের রচনাসমগ্র আছে। ‘তত্ত্ববোধিনী’, ‘প্রবাসী’, ‘শনিবারের চিঠি’, ‘ছোলতান’, ‘মোহাম্মদী’, ‘সওগাত’ ইত্যাদি পত্রিকার কপি ছাড়াও দৈনিক পত্রিকার ফিচার কাটিং আছে প্রায় ৫০ বছরের। শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহের অন্য দিনগুলোয় খোলা থাকে পাঠাগার। পাঠক এলে মুগ্ধ না হয়ে পারেন না। রায়পুরার আদিয়াবাদ কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ফাহিম বলেন, ‘আমার বাড়ি স্যারের বাড়ির পাশেই। একটা মানুষ বইয়ের জন্য এত পাগল হতে পারে, স্যারকে না দেখলে বুঝতাম না। আমি সময় পেলে পাঠাগারে পড়তে যাই।’ নরসিংদী মাধবদীর জালপট্টি মসজিদের খতিব মুফতি মুহাম্মদ রাকিব বলেন, ‘তিনি আমার চাচা। তাকে দেখেই বই পড়ার আগ্রহ জন্মেছে আমার।’

যেমন আছে পাঠাগারটি
পাঠাগারটি শুরু করেছিলেন মাতৃভিটায়। সেখানে প্রায় পঞ্চাশ বছর ছিল। বর্তমানে ডা. অছিউদ্দীনের হাতেগড়া প্রতিষ্ঠান উম্মুল কুরা মাদরাসার এক কক্ষে পাঠাগার নিয়ে এসেছেন। ডা. অছিউদ্দীন বললেন, ‘তিল তিল করে গড়া পাঠাগারের স্থায়ী কোনো স্থাপনা নেই। টাকার অভাবে বইয়ের যত্ন নিতে পারছি না। সরকার এগিয়ে এলে বড় উপকার হতো। আমার ছেলে মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহকে অসিয়ত করেছি, সে এ পাঠাগারের দেখাশোনা করবে।’

যারা এসেছেন
লন্ডন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও জীবনানন্দ গবেষক উইলিয়াম রাদিচে জাগরণী পাঠাগারে আসেন ১৯৯০ সালে। ২০০৮ সালে এসেছিলেন তৎকালীন নরসিংদী জেলার অ্যাডিশনাল ডিসি বিজয় কান্তি। এ ছাড়াও বহু গুণীজন পাঠাগার পরিদর্শনে এসেছেন। সবই যারপরনাই মুগ্ধ হয়েছেন।

বইও লিখেছেন
শিক্ষকতা, ডাক্তারি, পাঠাগার পরিচালনার পাশাপাশি লেখালেখিও চালিয়ে গেছেন অছিউদ্দীন। সম্পদনা করেছেন মাসিক পত্রিকা ও সাময়িকী। তার সম্পাদিত বই জাগরণ, অগ্রদূত, লাব্বাইক, নাজাত, নওরোজ—বেশ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা আটটি। এর মধ্যে ‘মরমি কবি সাবির জীবনদর্শন’, ‘কোরআন মাজিদের বিষয়ভিত্তিক আয়াত’, ‘আল কোরআনের ভাষায় ইতিহাসের শিক্ষা’, ‘মক্কা-মদিনা ও হজের বিধি-বিধান’, ‘পয়গামে রাসুল’ উল্লেখযোগ্য।

কেমন আছেন ডা. অছিউদ্দীন
নরসিংদীর রায়পুরার আদিবাদ ইউনিয়নের সেরাজনগর (নয়াচর) ডা. অছিউদ্দীনের বাড়ি, জন্ম ১৯৪৬ সালে। দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স) পড়েছেন কওমি মাদরাসা থেকে। ১৯৭৩-৭৪ সালে নরসিংদী সরকারি কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে বিএ পাস করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোয় দেশরক্ষায় কাজ করেছেন। ৬ সন্তানের জনক তিনি। সবাই ইসলাম বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। বর্তমানে তিনি অসুস্থ। বার্ধক্যজনিত রোগ বাসা বেঁধেছে শরীরে। তবুও প্রতিনিয়ত ভাবেন পাঠাগার নিয়ে—কীভাবে এটিকে টিকিয়ে রাখা যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *