টাঙ্গাইল জেলা প্রাচীনকাল থেকেই বয়ন শিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ নামটি যেন প্রবাদে পরিণত হয়েছিল। বলা হয়, চমচম টমটম ও শাড়ি/এই তিনে টাঙ্গাইল বাড়ি। সম্প্রতি এ শাড়ি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিওগ্রাফিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন (জিআই) পণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ার খবরে এ দেশের সচেতন মহল অনেকটা বিস্মিত ও বিব্রত বলা চলে। চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি ভারত টাঙ্গাইল শাড়িকে পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে ১০ বছরের জন্য সনদ দেয়।
৩ ফেব্রুয়ারি ‘টাঙ্গাইল শাড়ি বাংলাদেশের নয়, দাবি ভারতের’ শিরোনামে পত্রিকায় খবর প্রকাশের পর বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। এরপর নড়েচড়ে বসে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। ৮ ফেব্রুয়ারি শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন পেটেন্টস, ডিজাইন এবং ট্রেডমার্ক বিভাগ (ডিপিডিটি) টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে একটি জার্নাল প্রকাশ করে।
রোববার মন্ত্রিসভার বৈঠকে টাঙ্গাইল শাড়িসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন পণ্যের ভৌগোলিক নির্দেশক জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পেটেন্ট, ডিজাইন এবং ট্রেডমার্ক বিভাগ (ডিপিডিটি) ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসক এবং আটটি বিভাগের বিভাগীয় কমিশনারকে প্রতিটি জেলায় জিআই পণ্যের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
এর আগে টাঙ্গাইল শাড়িসহ তিনটি পণ্যের জিআই সনদ প্রধানমন্ত্রীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয় শিল্প মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। শিল্প মন্ত্রণালয় ডিপিডিটিতে জার্নাল প্রকাশের মাধ্যমে টাঙ্গাইল শাড়িকে প্রাথমিকভাবে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এত দিন তাঁরা দিবানিদ্রায় আচ্ছন্ন ছিলেন কেন?
বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার নামে তৈরি টাঙ্গাইল শাড়ি কীভাবে ভারতের নিজস্ব সম্পদ হলো? টাঙ্গাইল জেলা তো বাংলাদেশের ভেতরে এবং শত শত বছর ধরে এখানকার তাঁতিরা টাঙ্গাইল শাড়ি বয়ন করে আসছেন।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, টাঙ্গাইল শাড়িকে নিজেদের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিতে গিয়ে ভারতে অর্ধসত্য ও বিভ্রান্তিকর তথ্যের আশ্রয় নিয়েছে। এ নিয়ে ভারতের আদালতে বাংলাদেশের দ্রুত মামলা করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি। ভারতের জিআই আইন অনুযায়ী জিআই-এর বিষয়ে আপত্তি থাকলে তিন মাসের মধ্যে সেটি জানাতে হবে।
দেশভাগের পর টাঙ্গাইলের হিন্দু তাঁতিরা ভারতে পালিয়ে গেছেন এবং পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে তাঁরা টাঙ্গাইল শাড়ি বুনেছেন বলে যে যুক্তি দেওয়া হয়েছে, তা ঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে টাঙ্গাইল অঞ্চলে দীর্ঘ সময় ধরে শুধু হিন্দু নয়, মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ এই শাড়ি বয়ন করেন। সে ক্ষেত্রে ভারত যে যুক্তিতে টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই করেছে, তা ঠিক নয়। এক দেশের তাঁতিরা অন্য দেশে চলে গেলে শাড়ির ভৌগোলিক পরিচয় মুছে যায় না।
পণ্যের জিআই স্বীকৃতির ক্ষেত্রে জরুরি হলো বাংলাদেশের পক্ষের যুক্তি ও তথ্য–উপাত্তগুলো তুলে ধরা। এ বিষয়ে ভারত বা অন্য কোনো দেশের সঙ্গে বিরোধ দেখা দিলে আলোচনার মাধ্যমে সেটি সমাধান করা। আর দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধান না হলে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক ফোরামে যেতে হবে।
এর মধ্যে আছে প্যারিস কনভেনশন ফর দ্য প্রটেকশন অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রপার্টি (১৮৮৩), মাদ্রিদ অ্যাগ্রিমেন্ট অন ইনডিকেটর অব সোর্স (১৮৯১), লিসবন অ্যাগ্রিমেন্ট ফর দ্য প্রটেকশন অব অরিজিন অ্যান্ড দেয়ার ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রেশন (১৯৫৮) এবং ডব্লিউটিওর বাণিজ্যবিষয়ক মেধাস্বত্ব আইন (ট্রিপস-১৯৯৪)।
উল্লেখ্য, আইন ও বিধিমালা পূরণ করে বাংলাদেশের ২১টি পণ্য জিআই সনদ পেয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জামদানি শাড়ি, বাংলাদেশের ইলিশ, রাজশাহীর সিল্ক ও ঢাকার মসলিন। আমরা আশা করব, আমাদের নিজস্ব ও ঐতিহ্যবাহী প্রতিটি পণ্যের জিআই স্বীকৃতি আদায় করতে সরকার দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।